ঈমান, ইসলাম ও ইহসান
সুহাইল আল হাবিব:
ঈমান, ইসলাম ও ইহসান কী?
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসেছিলাম, এমন সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের সামনে উপস্থিত হয়, যার কাপড় ছিল ধবধবে সাদা, চুল ছিল ভীষণ কালো; তার মাঝে ভ্রমণের কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। আমাদের মধ্যে কেউ তাকে চিনতে পারে নি। সে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে গিয়ে বসে, নিজের হাঁটু তার হাঁটুর সঙ্গে মিলিয়ে নিজের হাত তার উরুতে রেখে বললেন:
“হে মুহাম্মাদ, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন”।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
“ইসলাম হচ্ছে এই- তুমি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল, সালাত প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত আদায় কর, রমাদানে সওম সাধনা কর এবং যদি সামর্থ থাকে তবে (আল্লাহর) ঘরের হজ্জ কর।”
তিনি (লোকটি) বললেন:
“আপনি ঠিক বলেছেন”।
আমরা বিস্মিত হলাম, সে নিজে তার নিকট জিজ্ঞাসা করেছে আবার নিজেই তার জবাবকে ঠিক বলে ঘোষণা করছে।
এরপর বলল:
“আচ্ছা, আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন”।
তিনি (রাসূল) বললেন:
“তা হচ্ছে এই- আল্লাহ্, তাঁর ফিরিশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ ও আখেরাতর উপর ঈমান আনা এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনা।”
সে (আগন্তুক) বলল:
“আপনি ঠিক বলেছেন”।
তারপর বলল:
“আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন।”
তিনি বলেন:
“তা হচ্ছে এই- তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদাত কর যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ, আর তুমি যদি তাঁকে দেখতে নাও পাও তবে তিনি তোমাকে দেখছেন”।
সে (আগন্তুক) বলল:
“আমাকে কেয়ামত সম্পর্কে বলুন”।
তিনি (রাসূল) বললেন:
“যাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে সে জিজ্ঞাসাকারী অপেক্ষা বেশী কিছু জানে না”।
সে (আগন্তুক) বলল:
“আচ্ছা, তার লক্ষণ সম্পর্কে বলুন”।
তিনি (রাসূল) বললেন:
“তা হচ্ছে এই- দাসী নিজের মালিককে জন্ম দেবে, সম্পদ ও বস্ত্রহীন রাখালগণ উঁচু উঁচু প্রাসাদে দম্ভ করবে”।
তারপর ঐ ব্যক্তি চলে যায়, আর আমি আরো কিছুক্ষণ বসে থাকি। তখন তিনি (রাসূল) আমাকে বললেন:
“হে উমার, প্রশ্নকারী কে ছিলেন, তুমি কি জান?
আমি বললাম:
“আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল অধিক ভাল জানেন”।
তিনি বললেন:
“তিনি হলেন জিবরীল। তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে তোমাদের কাছে এসেছিলেন।”
[সহীহ্ মুসলিম: ৮]
সারংশ
হাদিসে জিবরাইল নামক বিখ্যাত এই হাদিসে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাদের সংবাদ জানাচ্ছেন যে, একবার সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতিতে হযরত জিবরাইল আ. অজ্ঞাত পরিচয়ে ব্যক্তির বেশে প্রশ্নকারী শিক্ষার্থীর ন্যায় আগমন করে নবী সা. এর সামনে বসেন।অতঃপর ইসলাম ঈমানও ইহসান সর্ম্পকে প্রশ্ন করলেন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. ইসলামের মৌলিক দিকগুলো তুলে ধরলেন- আল্লাহ একমাত্র উপাস্য এবং মুহাম্মাদ সা. কে তাঁর রাসূল হিসেবে স্বীকার করা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়া, যথাযোগ্য মর্যাদায় রমযান মাসের রোযা পালন করা, যাকাত দানে সক্ষম ব্যক্তিদের যাকাত আদায় কারা এবং হজ পালনে সক্ষম ব্যাক্তিদের হজ পালন করা।
ঈমানের পরিচয়ঃ
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এভাবে- আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, সর্বগুণের পরিপূর্ণ এবং যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
ফিরিশতাদের প্রতি বিশ্বাসঃ
ফিরিশতাগণ আল্লাহ তায়ালার সম্মানিত ও অনুগত সৃষ্টি। তারা কখনো আল্লাহ তায়ালার নাফরমানী করেন না, তার আদেশকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে থাকেন।
কিতাবের প্রতি বিশ্বাসঃ
আসমানি কিতাবগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর সম্মানিত রাসূলদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে।
রাসূলদের প্রতি বিশ্বাসঃ
রাসূলগণ আল্লাহর পক্ষ থেকৈ দ্বীনের প্রচারক এই বিশ্বাস রাখা।
ইহসান বুঝাতে গিয়ে তিনি বলেন: মানুষ এমন ভাবে এবাদত করবে যেন সে আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করছে। যাদি সে তার ইবাদত কে এরূপে প্রতিষ্ঠা করতে না পারে তাহলে খুব ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে এবং বিশ্বাস রাখবে যে তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বদর্শী, কোন বিষয়ই তার কাছে গোপন নেই।
কিয়ামতের জ্ঞান প্রসঙ্গেঃ কিয়ামতের জ্ঞান কোন জীবের নিকট নেই, শুধু তার নিদর্শন সম্পর্কে কিঞ্চিত জ্ঞান আছে। আর তা হলো, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তাদি অধিক পরিমানে হবে। অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা থাকবে। অথবা সন্তান মায়েদেরকে ব্যপকভাবে অপমান করবে। তাদের সাথে বাদীর মত আচরন করবে। শেষ যামানায় রাখাল ও নিন্মে শ্রেণির লোকেরা বিপুল ধন-রত্নের অধিকারী হবে তারা পরস্পরে অহংকার প্রদর্শন করবে এবং সুবৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে।
রাসূল সা. এর ক্থা- ‘জিবরাইল আ. তোমাদের দ্বীন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে এসেছেন’ এর তাৎপর্য হল উপরোক্ত প্রশ্ন ও উত্তরগুলো জিবরাইল আ. কর্তৃক এই মনোনিত ধর্ম শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে বর্ণিত হয়েছে।
হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
* ফিরিশতাগণ যেকোন আকৃতি ধারন করতে পারেন।
* শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থী ও প্রশ্নকারীর আদব ও মান্যতার ধরণ।
* ইসলাম ও ইমান শব্দদ্বয় একত্রে ব্যবহার হলে ইসলামের ব্যাখা করা হয় বাহ্যিক কার্যকলাপ দ্বারা আর ইমানের ব্যাখা করা হয় আত্নিক কার্যকলাপ দ্বারা।
* ইসলাম , ইমান ও ইহসান শব্দত্রয় দ্বারা দ্বীন বা ধর্ম উদ্দেশ্য।
* কিয়ামত এমন বিষয়ের অন্তরগত যার জ্ঞান আল্লাহর নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। কুরআনের ভাষ্যমতে নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে।
* কিয়ামতের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে ধন-সম্পদ ও সন্তানাদির আধিক্য কিংবা সন্তান কর্তৃক মাতৃজাতির লাঞ্ছিত হওয়া।
* ভাগ্যের প্রতি অবিচল আস্থা পোষন করা এবং মানুষের প্রতি আল্লাহ ভাল মন্দ যা নির্ধারণ করেছেন তা সানন্দ চিত্তে আবশ্যকরূপে মেনে নেয়া।
* যে বিষয়ের মানুষের জ্ঞান নেই যে বিষয়ে অধিক তত্ত তালাশ না করা।
* অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা তথা বৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণ ও আত্নগরীমা প্রদর্শন এ সবই নিন্দনীয়।
* কিয়ামতের নিদর্শনের সংবাদ হল কমজাত ও নিঃস্ব লোকদের জন্য পৃথিবী উন্মুক্ত হবে এবং তারা বড় বড় প্রসাদ নির্মাণে প্রতিযোগি হবে এবং তারা এগুলোই করতে থাকবে।